বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও উৎপাদক হিসাবে উদ্ভিদের উপর তার প্রভাব

ড.বিশ্বজিৎ দে

লেখক সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (পঃ বঃ উচ্চশিক্ষা বিভাগ), হুগলি মহসিন কলেজ

পরিবেশগত সমস্যাগুলির মধ্যে বিশ্ব-উষ্ণায়ন(গ্লোবাল ওয়ার্মিং) আজ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যা মানব সভ্যতাকে সরাসরি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে। কারণ আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম  পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে  যা উল্লেখযোগ্যভাবে এই বাসযোগ্য গ্রহের তাপ গ্রহন এবং বিকিরণের ভারসাম্যকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।  বিশ্ব-উষ্ণায়ন পৃথিবীকে এখনই ক্রমাগত উষ্ণ জলবায়ুর সন্মুখীন করছে  এবং পরবর্তী শতাব্দীতে সম্ভাব্য সকল প্রতিকূলতার বিচরনক্ষেত্রে পরিণত করবে।

বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরে এই বিষয়ে কাজ করছেন এবং 19 শতকের পর তাদের কাজ থেকে জানা যায় যে কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2), মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প।  এদের মধ্যে CO2 হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রিনহাউস গ্যাস যার পরিমাণ মানুষের কার্যকলাপ দ্বারা দারুনভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।  CO2 তৈরি হয় পশু থেকে উদ্ভিদ সকল সবাতশ্বসনকারীর  শ্বসন  প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং যেকোনো ধরনের জ্বালানীর (উদ্ভিদ জীবাশ্ম কয়লা, তেল, গোবর,কাঠ সহ অন্যান্য কার্বন গঠিত যৌগের  ) দহন, জ্বলন বা পোড়ানোর জন্য  ।

শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে CO2 এর বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে নিয়মিত ভাবে যা শুরু হয়েছিল 1750 সালে  শিল্পবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে CO2 এর ঘনত্ব ছিল প্রায় 280 অংশ প্রতি মিলিয়ন ভলিউমে (ppmv) যা 1994 সালের মধ্যে 358 অংশ পিপিএমভি হারে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে। চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত যে এই ঘনত্ব বর্তমানে বাড়ছে প্রায় 1.5 শতাংশ হারে প্রতি বছর।  এভাবে  চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে CO2 ঘনত্ব 500 ppmv এর কাছাকাছি হবে। (ছবি – ১,২)

                    (ছবি – ১)

                   (ছবি – ২)     

ফলস্বরূপ, অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন এই নিয়ন্ত্রণের কারনে হয়তো ভবিষ্যতে  গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির নির্গমনের হার  লাগামহীন হলে তার প্রভাবে দ্রুততর হবে উষ্ণতা প্যাটার্ন। যদিও ভবিষ্যতের উষ্ণায়নের প্যাটার্নটি কেমন হবে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে, তবু এটা নিশ্চিত যে আগামী কয়েক দশকে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির নির্গমনের হার  লাগামহীন হলে তার প্রভাবে যে পৃথিবীর পৃষ্ঠ উষ্ণ হবে তা নিশ্চিত।

19 শতকের শেষের দিক থেকে ,যখন নির্ভরযোগ্যভাবে তাপমাত্রা পরিমাপ শুরু তখন থেকেই গড়ে 0.3 থেকে 0.6 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি একশ বছরে। সাম্প্রতিক দশকগুলি দেখা যাচ্ছে 1400 সালের তুলনায় প্রায় প্রতিটি দশকই  উষ্ণতম দশক হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে ক্রমাগত।

বর্তমান অবস্থা এখন এমন যে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা 2100 সালের মধ্যে 1 থেকে 3.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে । এরই ফলশ্রুতিতে প্রাকৃতিক জীব এবং বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার এই ঘটনা মরুপ্রদেশ সহ বরফাবৃত পাহাড়ে জমে থাকা বরফ গলে গিয়ে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে গড়ে প্রায় 15 থেকে 95 সেন্টিমিটার ।  সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি অনেক নিচু, ব-দ্বীপ অঞ্চল এবং ছোট দ্বীপের জমির সম্পূর্ণ ক্ষতি ও বিলুপ্তির কারন হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে। অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ছোট জলাশয়, হ্রদ,শাখানদী,উপনদীগুলি অত্যধিক তাপমাত্রার কারনে শুকিয়ে যাচ্ছে (ছবি – নীচে যথাক্রমে ৩,৪)।

বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কিত কিছু সংজ্ঞা:

 ১. গ্লোবাল ওয়ার্মিং পোটেনশিয়াল ( GWP ) : কী পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হলে কত পরিমাণ উয়ায়ন ঘটাবে তার হিসাবনিকাশকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং পোটেনশিয়াল বলে । একে শতকরা হিসাবে প্রকাশ করা হয়।

  ২. কার্বন ট্রেডিং ( Carbon Trading ) : কার্বন ট্রেডিং বলতে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের অধিকার স্বত্ব সংক্রান্ত বাণিজ্যকে বোঝায় । এই ব্যবস্থায় কোনো একটি বা একাধিক দেশের গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট স্তরে দূষণ সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় । তারপর বিভিন্ন সংস্থা ও শিল্পের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কালে দূষণের | মাত্রা নির্দিষ্ট করে এবং সেই পরিমাণ দূষণের অধিকার সংক্রান্ত অনুমতি দেয় ।

৩. কার্বন পদাঙ্ক ( Carbon Foot Print ) : কার্বন পদাঙ্ক বলতে বোঝায় আমরা কতটা কার্বন রোজ খরচ করি অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের ফলে কতটা কার্বন তৈরি হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশছে । সাধারণত একবছরে মোট কত টন CO২ তৈরি হয় বা ব্যবহৃত হয় তার হিসাব করা হয়।

৪. কার্বন ট্যাক্স ( Carbon Tax ) : এটি প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ধারিত হয় । এই ট্যাক্স ধরা হয় জীবাশ্ম জ্বালানিতে ( কয়লা , পেট্রোলিয়াম অথবা প্রাকৃতিক গ্যাস ) মোট কার্বন নির্গমনের ওপর ।

৫. গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ( Green Climate Fund ) : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলিকে প্রতিরোধ করতে এবং ইতিমধ্যে যে সমস্ত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য যে বাড়তি খরচের প্রয়োজন সেই ব্যয়ভার মেটানোর জন্য গঠিত তহবিল হল গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড । 2009 সালের সম্মেলনে এর গঠনের প্রস্তাব ওঠে , 2010 সালে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় এবং 2011 সালের ডারবান সম্মেলনে এই ফান্ড গঠন করা হয় । 2015 সালের হিসাব অনুযায়ী এই তহবিলের আয়তন মাত্র 10 বিলিয়ন ডলার ।

বিশ্ব উষ্ণায়নের কারনে উদ্ভিদ প্রজাতির উপর প্রভাব:

        ভূ উষ্ণতা যে বহুলাংশে বায়ুমণ্ডলীয় CO2 র কারনে তা এখন আর কারও অজানা নয় । আবার এই প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস ভূ- পৃষ্ঠের চারপাশে একপ্রকারের নিরোধক সরবরাহ করে যা পৃথিবীতে জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আবরনের কার্য করে। আবার CO2 – এর ঘনত্ব ও বায়ুমণ্ডলে দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু ওঠানামার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভাল প্রমাণও রয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাস হিসাবে CO2 এর প্রভাব বিবিধ।  যদি অন্যান্য জলবায়ুগত কারণগুলি স্থিতিশীল থাকে তবে CO2 – এর ঘনত্ব উদ্ভিদের দৈনন্দিন কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে।  উপরন্তু, বাতাসে অতিরিক্ত CO2 বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকেও প্রভাবিত করে। অন্যদিকে প্রাথমিক উৎপাদকের পরিমাণগত এবং গুণগত পরিবর্তন উৎপাদকের উপর নির্ভরশীল প্রাণী এবং মাইক্রোবিয়াল সম্প্রদায়গুলিকে প্রভাবিত করবে। 

কৃষিক্ষেত্রে উষ্ণায়নের প্রভাব:

CO2 আত্তীকরনের পরিমান ও পদ্ধতি অনুযায়ী উচ্চতর-উদ্ভিদের মধ্যে, তিনটি বিভাগ রয়েছে- C3,  C4, এবং CAM । বাতাসে CO2 র পরিমান বেশি হলে C3 শ্রেনীর গাছপালা অবশ্যই বেশি উপকৃত হবে।  কারন ঐ শ্রেণীর উদ্ভিদের মধ্যে সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধি সরাসরি বায়ুমণ্ডলীয় CO2 পরিমানের সাথে সমানুপাতিক। CO2 র পরিমান বৃদ্ধির সাথে সাথেই C3 উদ্ভিদের জলের ব্যবহার দক্ষতাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে। কার্বন বরাদ্দের ধরণ প্রায়ই পরিবর্তিত হয় যখন উদ্ভিদ উচ্চতর CO2 ঘনত্বে বৃদ্ধি পায় তবে তা অবশ্যই প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন ভাবে হয়ে থাকে।

        সাধারণভাবে CO2 – দ্বারা অনুপ্রাণিত বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায় প্রায় সকল প্রজাতির উদ্ভিদে। কিছু প্রজাতিতে 700 পিপিএম CO2 তে উদ্ভিদের মূল অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পায়। পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রাপ্যতা সীমাবদ্ধ না হলে প্রায় সময়েই CO2 বৃদ্ধির সাথে উদ্ভিদের সামগ্রিক বৃদ্ধির হার সমানুপাতিক।  উচ্চতর CO2 স্তরে, নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরিবর্তনগুলিকেও সীমাবদ্ধ করে। যেমন CO2 বৃদ্ধির কারনে বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা উদ্ভিদের মধ্যে ঘটে চলা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া গুলিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে , যেমন সালোকসংশ্লেষণের হার পরিবর্তন, তাপমাত্রা দ্বারা উদ্ভিদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া এবং উত্পাদনশীলতা।

বিভিন্ন মডেল দ্বারা অনুমান করা হয়েছে যেসব গাছের প্রজাতি উচ্চ CO2 ঘনত্বের প্রতি সাড়া দেয় , ভবিষ্যতের জলবায়ু যখন CO2 সমৃদ্ধ হবে- তখন সেইসব গাছপালা ইতিবাচকভাবে উপকৃত হবে (ফারকুহর, 1997)।  উচ্চ CO2 ঘনত্বের উপকারী প্রভাব C3 উদ্ভিদগুলিকে যেমন গম, চাল, বার্লি, ওটস, চিনাবাদাম, তুলা, সুগার বিট, তামাক, পালং শাক, সয়াবিন এবং অধিকাংশ গাছ সমূহকে ভবিষ্যতে উচ্চতর CO2 আত্মীকরণের দিকে পরিচালিত করবে। গবেষণা করে দেখা যাচ্ছে ঐ পরিবেশে সালোকসংশ্লের হার বৃদ্ধি পাবে, এবং  প্রস্রেদন- হার হ্রাস পাবে কারন stomatal প্রতিরোধের বৃদ্ধির ফলে গাছের জল ব্যবহারের দক্ষতার  হার আরও উন্নত হবে ।  অতএব, সেইসব উদ্ভিদের প্রজনন করাতে হবে যাতে তার বংশধরেরা উচ্চ CO2 প্রভাব থেকে উপকৃত হতে সক্ষম ।

এই কথা বিবেচনা করে ইন্টারন্যাশানাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ( IRRI) বেশ কয়েকটি দেশের সহযোগিতায এমন ট্রান্সজেনিক ধানগাছের উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন যেখানে C4 প্রজাতির (যেমন, ভুট্টা এবং বার্লি) ক্লোন করা জিন কাজে লাগিয়ে  সালোকসংশ্লেষণকে C3 থেকে C4 পথে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলে অত্যধিক তাপমাত্রায় stomatal প্রতিরোধের বৃদ্ধি পাবে ও প্রস্রেদন- হার হ্রাস করে দেহে জল ব্যবহারের দক্ষতার  হার আরও উন্নত হবে। এই অবস্থায় শ্বসনে উদ্ভূত CO2 কে দেহের বাইরে বেরোনোর রাস্তা না পাওয়ায় কোষমধ্যে CO2 পরিমান বৃদ্ধি পাবে যা এই  ট্রান্সজেনিক ধানগাছগুলিকে C4 পদ্ধতিতে সালোকসংশ্লেষণ করানোর দিকে নিয়ে যাবে। এর ফলে অতিরিক্ত CO2 আত্তীকরণের প্রভাবে গাছের ফলনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বায়ুমণ্ডলে উচ্চতর CO2 ঘনত্বের কারণে নিম্নশ্রেণীর উদ্ভিদের মধ্যে প্রচুর জৈবিক পরিবর্তন ঘটে এবং প্রজাতি বণ্টনের বৈচিত্র্যের ভারসাম্য কে বদলে দিতে পারে।  যে পথগুলি দ্বারা তাপমাত্রা এবং বায়ুমণ্ডলীয় CO2 তে ঘনত্ব পরিবর্তন  উদ্ভিদ সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে পারে সেগুলিকে দুটি ভাগভাগ করা যেতে পারে: (a) তাপমাত্রার প্রভাব এবং (b) উচ্চ CO2 এর প্রভাব।  ক্রমবর্ধমান CO2 ঘনত্বের জন্য সমগ্র সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব কঠিন।  কারণ CO2 তে পরিবর্তনে যা ঘটছে  তার কোন সাম্প্রতিক প্রামাণ্য নথির নজির নেই।  বিপরীতে তাপমাত্রার প্রভাবের সম্প্রদায়ের উপর কি প্রভাব পড়ছে তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে।

        কৃষির উপর CO2 -বৃদ্ধির প্রভাব  তিনটি স্তরে বিবেচনা করা যেতে পারে।  পৃথক ফসলের প্রতিক্রিয়া স্তরে তাপমাত্রায় পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত এবং CO2 ঘনত্ব। যুক্তিসঙ্গতভাবে ভাল বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রক্রিয়া দ্বারা ফসলের কর্মক্ষমতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।  আঞ্চলিক স্কেলে ফসলের ফলন  পরিবর্তনের সম্ভাবনার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য প্রতিটি অঞ্চলে পরিবেশগত পরিবর্তনের মিশ্রণ বিবেচনা করা প্রয়োজন।  পরিশেষে এটা নির্ভর করবে CO2 বৃদ্ধির সাথে খাপ খাইয়ে কৃষিক্ষেত্রে মেনে চলা অভ্যাসের কতটা বদল ঘটানো যেতে পারে তার উপর যা খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সরাসরি যুক্ত। 

# জলভাগ,জলাভূমি ও উষ্ণায়ণের প্রভাব

স্থলজ পরিবেশের চেয়ে জলজ জীবনে পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেওয়া অনেক বেশি কঠিন, বিশেষ করে জলাভূমির বৃহৎ অংশের জন্য।  মূল সমস্যা হলো বৈশ্বিক জলবায়ু এবং মহাসাগরের মধ্যে সম্পর্ক সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া খুবই দুর্বল ।  যাইহোক জলবায়ু পরিবর্তনের মত CO2 পরিমান পরিবর্তন জলজ পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে যা শুধুমাত্র পৃথক প্রজাতির জনসংখ্যাকেই প্রভাবিত করে না বরং প্রজাতির সমগ্র সমাবেশকেও প্রভাবিত করে।    

বেশ কয়েকটি বিশেষ জলজ পরিবেশ এই পরিবর্তনগুলি দ্বারা প্রভাবিত হবে যেমন, প্রবাল প্রাচীরের জীবন পরিবর্তন, মাছচাষের এলাকার পরিবর্তন এবং সামগ্রিক উৎপাদক উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতা।  সামগ্রিকভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনগুলি সমুদ্রের জলজ ব্যবস্থায় জৈবিক জীবনের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।  আবহাওয়া তে CO2 ঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্রের জলে আরও বেশি করে বায়বীয় CO2 মিশতে থাকে। ফলে সামুদ্রিক জলজ পরিবেশের অম্লত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলসরূপ সমুদ্রে বসবাসকারী সকল উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপে অবাঞ্ছিত পরিবর্তন ঘটে চলে। ফলে সমুদ্রের জলে উৎপাদক উদ্ভূত অক্সিজেনের পরিমানে তারতম্য ঘটে যায়। যা জলজ সমস্ত জীবের জীবনচক্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বেড়ে চলা CO2 এর ঘনত্বের সাথে উদ্ভিদগোষ্ঠীর  মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া বা ইন্টারঅ্যাকশন কিভাবে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পরিসীমা, আকার এবং প্রাচুর্য নির্ধারণ করে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এটা জানা  অত্যন্ত প্রয়োজন।

# বিষুব অঞ্চলে উষ্ণায়নের প্রভাব:

বর্ধিত CO2 জনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধি কারনে যে সব সমস্যা বিষুব অঞ্চলের উদ্ভিদের জীবনকালে আসতে পারে ও তার দীর্ঘস্থায়ী ফলশ্রুতিতে যে সব ঘটনা ঘটতে পারে সেগুলি হল-

 কৃষি উৎপাদনে হ্রাস, কৃষি উৎপাদনে পরিবর্তন, কোষদেহে জলের মাত্রা হ্রাস পেয়ে অম্লত্ব বৃদ্ধির কারনে প্রজাতির বিলুপ্তি , সালোকসংশ্লেষণ এবং শ্বাস প্রশ্বাসের প্রাপ্যতার উপর বিঘ্নিত প্রভাব , মৌসুমী সমন্বয়ের ব্যাঘাত , প্রজাতির বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া , প্রজাতির প্রাচুর্যের পরিবর্তন , প্রজাতির গঠন পরিবর্তন প্রভৃতি।

# নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণায়নের প্রভাব:

নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণায়নের প্রভাবে প্রকৃতি পরিবেশে অত্যধিক CO2 বৃদ্ধির কারনে যে সব সমস্যা উদ্ভিদের জীবনকালে আসতে পারে ও তার স্বল্পকালীন ও দীর্ঘস্থায়ী ফলশ্রুতিতে যে সব ঘটনা ঘটতে পারে সেগুলি হল-

১) বর্ধিত কৃষি উৎপাদন , ২) চারণ ভূমির পরিধি বৃদ্ধি, ৩) মানুষের দীর্ঘস্থায়ী বাসস্থান, ৪) শুষ্ক অঞ্চলের উপনিবেশ বৃদ্ধি, ৫) মৌসুমী সময়ের স্বল্পতা বৃদ্ধি, ৬) জলের ব্যবহার দক্ষতার (WUE) ফলে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন বৃদ্ধি, ৭) বর্ধিত নাইট্রোজেন ব্যবহার দক্ষতা (NUE), ৮) বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি, ৯) প্রজাতির বৈচিত্র্যগত প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা, ১০) প্রজাতির পরিবর্তনে প্রজাতির প্রাচুর্যের পরিবর্তন, ১১) বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যায় পরিবর্তন

# উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও উষ্ণায়ন

বিগত কয়েক দশক ধরে এটা অনুভূত হচ্ছে যে পরিবেশগত পরিবর্তন এবং সংশ্লিষ্ট মানুষ্যসৃষ্ট ক্রিয়াকলাপের কারণে প্রজাতির বিলুপ্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এইভাবে বিভিন্ন প্রজাতিকে  বিলুপ্তির হাত থেকে প্রভূত জেনেটিক বৈচিত্র্য সহ সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য বাঁচাতে  সংরক্ষণকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বেড়ে চলা  CO2 যে কোন প্রজাতির মধ্যে দুভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। নিজেদের শারীরবৃত্তীয় ও রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে অথবা শিকার-শিকারী, পরজীবী, প্রতিযোগী, মিথোজীবী সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তনের মাধ্যমে।

# তুষারাবৃত ও পার্বত্য অঞ্চলে উষ্ণায়নের প্রভাব:

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রভাবে ভূমন্ডলে এমন সব পরিবর্তন ঘটছে যা আগে কেউ কোনো দিন ভাবতেই পারেনি। যেমন , হিমশীতল এলাকাগুলোতে পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়া। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বায়ুর গড় উষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে এসব এলাকায় পার্মাফ্রস্টের বরফকঠিন আচ্ছাদন ক্রমশ গলে যাচ্ছে। গলে যাওয়ার হারটা আবার দিনদিন বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই এর পরিণাম নিয়ে দেখা দিয়েছে ঘোর দুর্ভাবনা(ছবি – ৫,৭)

                   (ছবি – ৫)    

বিজ্ঞানীদের হিসেবে, মোট ভূভাগের মোটামুটি ২০ শতাংশে ছড়িয়ে আছে পার্মাফ্রস্ট। উত্তর গোলার্ধে এর পরিমান একটু বেশি, প্রায় ২৫ শতাংশ। অবশ্য এযুগে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পার্মাফ্রস্ট যুক্ত এলাকার আয়তন ক্রমশ কমছে। গত ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে এমন এলাকা প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে।

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এমন সম্ভবনা প্রবল যে পার্মাফ্রস্ট গলে গেলে অতীত যুগের বিপজ্জনক রোগজীবাণু আবার ফিরে আসতে পারে। সাইবেরিয়ার ইয়ামাল উপদ্বীপে ২০১৬ সালের গরমকালে হঠাৎ করে অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এই সংক্রমণ ঘটেছিলো একটা বল্গা হরিণের হিমায়িত মৃতদেহ থেকে। সেই মৃতদেহটি ছিল প্রায় একশ বছরের পুরোনো। এতোদিন সেটা পার্মাফ্রস্টের নিচে চাপা পড়েছিলো। পার্মাফ্রস্টের গলনে সেটা বাইরে বেরিয়ে আসে।

কিছু দিন আগে নরওয়ের স্প তাতে একটি কিশোর ও ২০০০-এরও বেশি বল্গা হরিণ মারা যায় । গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রায় ২০ জন মানুষ। স্পিটসবার্গেন এলাকার কয়েকটা জায়গায় একদল বিজ্ঞানী পার্মাফ্রস্টের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চত হয়েছিলেন যে প্রতি গ্রাম হিমায়িত মিশ্রণে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। এদের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ ডিফ্রস্টিং-এর পরে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বিজ্ঞানীর সাইবেরিয়ায় পার্মাফ্রস্টের নিচ থেকে ২০১৪ সালে মিলিভাইরাস ও পিথোভাইরাস নামক দুটো ‘অতিকায়’ ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলেন ।

আরও অনেক গবেষণা লব্ধ বিজ্ঞান বলছে, এমন অনেক জীবাণু ও ভাইরাস আছে যারা সুদীর্ঘকাল বরফের মধ্যে জমে থাকার পরেও নষ্ট হয় না। অনুকূল পরিবেশে তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এগুলোর মধ্যে অনেকে আবার প্যাথোজেন বা রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু। (ছবি- ৫,৬)

                  (ছবি – ৬)

 বর্তমানে  বিশ্ব উষ্ণায়নএর কারনে পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর শীতল এলাকাগুলো আস্তে আস্তে ‘গরম’ হয়ে উঠছে। ফলে সেসব জায়গায় হিমায়িত পার্মাফ্রস্ট ক্রমশ গলে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকায় পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলাফল রীতিমতো আশংকাজনক। এর ফলে ভূমন্ডলে গভীর পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এর সম্ভাব্য পরিণামগুলো এরকম:—

গলনের ফলে পার্মাফ্রস্টের আয়তন কমে যায়। এর অনিবার্য পরিণতি পার্মাফ্রস্ট এলাকার মাটি বসে যাওয়া। ফলে নানা মাপের গর্ত ও খাদও তৈরি হতে পারে। বন এলাকায় মাটির গভীরে পার্মাফ্রস্টের গলনে মাটির তল ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকে। ফলে সেখানকার গাছগুলো অনবরত নিজেদের কান্ড বাঁকাতে বাধ্য হয়। এ থেকেই সৃষ্টি হয় অদ্ভুতদর্শন ‘নৃত্যরত বন’।(ছবি – ৭)

                                                            (ছবি – ৭)

পার্মাফ্রস্টের মধ্যে আটকে আছে বিপুল পরিমানে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্রিন হাউস গ্যাস। পার্মাফ্রস্ট যতো গলবে ততোই এই গ্যাসগুলো ছাড়া পেয়ে বায়ুতে মিশে যাবে। তাছাড়া পার্মাফ্রস্টের হিমায়িত মিশ্রণে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য ম্যামথ ও অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুর লাশ। প্রবল ঠান্ডায় এগুলোতে আজও পচন ধরেনি। কিন্তু পার্মাফ্রস্ট উষ্ণ হয়ে গলে গেলে এগুলো পচতে শুরু করবে। এর ফলেও প্রচুর পরিমানে মিথেন ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হবে। এ থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আরো বেড়ে যাবে।

উপসংহার :

CO2 বৃদ্ধির কারনে প্রবর্তিত পরিবেশগত পরিবর্তনগুলির হাত থেকে রক্ষা পেতে উদ্ভিদ-সংরক্ষণ একটি বিশেষ কৌশলগত দিক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

 উষ্ণায়নজনিত সমস্যার মূল কারক অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের আত্তিকরণ, পৃথগীকরণ ও মজুত করার হার বৃদ্ধির কারনে যে সব  দীর্ঘস্থায়ী ঘটনা ঘটতে পারে সেগুলি হল-

কৃষিক্ষেত্র ও চারণ ভূমির আয়তনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ,  শুষ্ক অঞ্চলে উপনিবেশ বৃদ্ধির কারনে জলাভূমি ও অরণ্যের পরিধি হ্রাস,জলের ব্যবহার দক্ষতা (WUE) ও বর্ধিত নাইট্রোজেন ব্যবহার দক্ষতা (NUE)র ফলে বৃদ্ধি-প্রবৃদ্ধির হারে বিরূপ পরিবর্তন, প্রজাতির বৈচিত্র্যগত প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা, প্রজাতির পরিবর্তনে প্রজাতির প্রাচুর্যের পরিবর্তন, বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যায় পরিবর্তন।

প্রকৃতি পরিবেশে মনুষ্যসৃষ্ট পরিবর্তনের ফলাফল কি ভয়ানক হতে পারে তা বর্তমানকালের খাল কেটে কুমির আনার করোনা পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সাধের, প্রাণের এই গ্রহ আগামী দিনে আরও কত ভয়ানক সমস্যার সন্মুখীন হতে পারে তার ট্রেলার বলা যেতে পারে এই করোনা প্যান্ডেমিককে।

             পরিশেষে বলা ভাল গবেষক, বিজ্ঞানী, সমাজসচেতক, রাজনীতিবীদ সহ সকল জনসাধারণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ভিন্ন এই চক্রব্যূহ থেকে পরিত্রাণের আশা দূরস্ত।



Categories: Uncategorized

Leave a comment