রকেট ওড়ার বিজ্ঞান

সংকেত হক 

About Author: Sanket is a postgraduate in Physics from University of Calcutta and working as Scientific Assistant in Variable Energy Cyclotron Centre [VECC]

___________________________________________________________________

লেখকের কথা –  এই লেখায় লোক-বিজ্ঞানের সনাতন ব্যাকরণ গুলো মানা হয় নি। লোক-বিজ্ঞান অধিকাংশ পত্রিকার সম্পাদক যে কথাটা বলেন সেটা হচ্ছে: “লেখার মধ্যে যেন অঙ্কের সমীকরণ দেবেন না। তাহলে আদ্ধেক লোক-ই ভয়ে পড়বে না”। স্কুলে মাধ্যমিক পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী দের মধ্যে অনেকেই ভবিষ্যতে Astronaut হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ISRO-র রকেট উৎক্ষেপণ T.V.-তে দেখানো হলে তারা বেশ মন দিয়ে দেখে। উচ্চ-মাধ্যমিকের বইতে রকেট ওড়ানোর মূল ধারণাটা পড়ানো হয়। পরীক্ষায় প্রশ্ন-ও পড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা বলে আমি বুঝেছি derivation-টা তাদের মাথায় ঠিক ঢোকে নি। সবাই মুখস্ত করেছে। এই প্রবন্ধে রকেট নিয়ে পাঠ্য বই-তে দেওয়া সেই derivation-টাকেই ধরে ধরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উচ্চ-মাধ্যমিকে মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়াশোনা করছে, প্রবন্ধটা মূলত: তাদের জন্য লেখা।  ইওরোপে যুদ্ধ গত এক বছর ধরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে Ballistic Missile এখন খুব চলতি শব্দ। ওই প্রসঙ্গ-ও খানিকটা আনা হোল। স্বভাবতই লেখায় বাংলা পরিশব্দ ব্যবহার নিয়ে ভুগতে হয়েছে এবং সাধারণত: মুখের কথা থেকে নেওয়া বাংলা পরিশব্দ গুলো ব্যবহার করার প্রচেষ্টা ছিল।

___________________________________________________________________

রকেট তৈরির প্রযুক্তি (Technology) ঠিক কবে থেকে এলো – এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন গত শতাব্দীর তেরোর দশকে চীন সবার আগে এই প্রযুক্তি এনেছিলো।  আমাদের দেশের Department of Archaeology, Heritage and Museums-এর বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে জানান আঠারোর দশকে মহীশূরের সুলতান টিপু ইংরেজের বিরূদ্ধে লড়াইতে রকেট ব্যবহার করেছিলেন।  তারপর এই প্রযুক্তি ব্রিটেনে পাচার হয়েছিলো।  বিশ শতকের গোড়া থেকে ব্রিটেন, রাশিয়ায় এ-নিয়ে কাজ চলতে থাকে।  পরে জার্মানিও যোগ দেয়।  কিন্তু রকেট নিয়ে গবেষণা তুঙ্গে ওঠে গত বিশের দশকে।  এই সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলেছিলো। নিউক্লিয় বোম তৈরির কায়দা তখন এই দু-দেশই জানতো।  

সোভিয়েতের পশ্চিম দিক ঘেঁষে ছিলো আমেরিকার বন্ধু দেশ গুলো।  সোভিয়েত ভাবলো – আমেরিকা চাইলে এদের জমি ব্যবহার করে তার ওপর বোমা ফেলতে পারে। কিন্তু উল্টোটা করা অত সোজা নয়। বোমারু বিমানে চরে অতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকায় বোমা ফেলে আবার ফেরৎ আসা কি মুখের কথা? তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো দূর পাল্লার (Range) ক্ষেপনাস্ত্র (Missile) বানাবে। আর সেই ক্ষেপনাস্ত্র এমন হবে যা কিনা নিউক্লিয় বোম বইতে পারে।  একবার ছুঁড়ে দিলে সুদূর সাগর পারি দিয়ে ঠিক লক্ষ্যে আঘাত করা যায়।  হালের ক্ষেপনাস্ত্র আসলে রকেটের-ই (Rocket) আধুনিক রূপ।  জটিলতা বাদ দিয়ে আকাশে রকেট চালনার (Propulsion) বিজ্ঞানটা এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।    

মনে করি, মাটিতে দাঁড়িয়ে কোনো দর্শক দেখছে যে একটা ভরযুক্ত (Massive) বস্তুকণা (Particle) স্থির অবস্থায় (At rest) আছে।  এখন তার ভর m । এবার কণাটি একদম সোজা (Linear) পথে চলতে শুরু করলো। ধরা যাক, ওই দর্শকের সাপেক্ষে গতির মান v । শূন্য মাধ্যমে (vacuum) আলোর গতির (সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল) তুলনায় v অনেক অনেক ছোট।  তাহলে, দর্শকের সাপেক্ষে কণাটার রৈখিক Momentum(p) = mv হবে ।

ধরা যাক, দর্শক এও দেখলো যে সময়ের সঙ্গে  p -এর মান এবং দিক বদলাচ্ছে না।  এই অবস্থায়, গতি নিয়ে মহাবিজ্ঞানী নিউটনের ২য় সূত্র[১]  অনুযায়ী প্রমান করা যায় কণাটার ওপর বাইরে থেকে কোনো বল (External Force) কাজ করছে না। একে বলা হয় Momentum-এর সংরক্ষণ (Conservation) নীতি। একটার পরিবর্তে অনেকগুলো কণার সমবায় (System) নিলে পুরো System-এর জন্য এটাই নিয়ম (Law)। তাহলে দেখা যাক, এই নিয়ম দিয়ে রকেট কি-করে ওড়ে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা।

শুনে খটকা লাগলে বাড়িতে হাতের কাছে থাকা কয়েকটা জিনিস দিয়ে চট করে একটা Experiment করে ফেলা যেতে পারে। ধরা যাক, ঘরের ভিতর দুখানা কাঠের চেয়ারকে কিছুটা দূরে উল্টোদিকে মুখ করে রাখা হলো।  এরপর, তাদের মধ্যে একটা শক্ত-পোক্ত সুতো বেঁধে দেওয়া হলো। একটা বড় বেলুনে বেশ অনেকটা হাওয়া ভরে তার মুখটা ভালো করে আঁটা হলো। দুটো প্লাস্টিকের ছোট্ট চোঙের মত অংশকে Cello tape দিয়ে ফোলানো বেলুনের ওপর দু-জায়গায় চিপকে দেওয়া হলো। এবার ওই চেয়ারে যে সুতো বাঁধা ছিলো, তার একদিক খুলে চোঙ গুলোর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হলো। এরকম অবস্থায় বেলুন পুরো শূন্যে ঝুলে (সূত্র: ছবি-২) থাকবে ।

এই সময় যদি বেলুনের মুখ হালকা খুলে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে – পেছন থেকে ভুসসস… করে হাওয়া ছাড়তে বেলুন এক চেয়ার থেকে আরেক চেয়ারের দিকে ছুটছে। একই ঘটনা রকেটের ক্ষেত্রেও ঘটে।

এবার দেখা যাক রকেটটাকে মাটি থেকে খাড়া ভাবে (Vertically) উঠোলে কি হয়। এখন আর বলা যায় না যে System-এর ওপর বাহ্যিক ভাবে কোনো বল কাজ করছে না (সূত্র: ছবি – ৪) ।  পৃথিবীর অভিকর্ষ বল(Gravity) আছে। তাছাড়া, বাতাসের বাধা (Air Drag) তো আছেই। অভিকর্ষ বল System-এর ভরের ওপর নির্ভর করে।  যেহেতু সময়ের সঙ্গে System-এর ভর কমতে থাকে, তাই তার ওপর অভিকর্ষ বলের প্রভাবও ক্রমশ: দুর্বল হয়ে আসে। অন্যদিকে, রকেটে প্রযুক্ত ঘাত পুরোটা সময় একই (Const.) থাকে।  তাহলে একটা সময় নিশ্চয় আসে যখন এই ঘাতটা উল্টোদিকে কাজ করা সব বাহ্যিক বলের মোট পরিমাণকে ছাপিয়ে যায় ।

আগের রকেটের জন্য এ-সব ধরে অঙ্কটা আবার কষলে[৩] কি পাওয়া যাবে সেটা ছবি: ৫-তে দেখানো হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে ইঞ্জিন চালু হওয়ার প্রায় ১.৫৭ মিনিট পরে রকেট মাটি ছেড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। মোট জ্বালানির কেবল ৬ শতাংশ তখনও ব্যবহার হয় নি। সব জ্বালানি শেষ হলে আমাদের সাপেক্ষে প্রতি সেকেন্ডে রকেটের গতি হয় ৬৪.৭৪ ফুট মাত্র ।

পৃথিবীর পিঠে(Surface) থাকা একটা ঢিলকে আকাশে যত জোরেই ছোঁড়া হোক না কেন, অভিকর্ষ বলের জন্য কিছু সময় পরে সেটা আবার মাটিতে নেমে আসে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী একমাত্র তখনই ঢিলটা অভিকর্ষের টান থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি পৃথিবীর বাইরে চলে যায় যদি একে সেকেন্ডে ৬.৯৬ মাইল বা তার বেশি গতিতে ছোঁড়া হয়। একে আমরা মুক্তি(Escape) বেগ বলি। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের কল্পনা করা রকেটের গতি এর অনেক নীচে। তাহলে গতি বাড়ানোর উপায় কি? অবশ্যই R-এর মান যথেষ্ট বাড়াতে হবে। এর জন্য System-এ জ্বালানির ভর যতটা পারা যায় বেশি করতে হবে। বিষয়টা তলিয়ে ভাবার জন্য আবার একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে।

পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েত প্রযুক্তিবিদরা ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন। রকেটের গতি বাড়াতে তারা মুক্তি বেগের চেয়ে বেশি করে ফেলেছিলেন। সেটা দিয়ে তারা মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন স্পুৎনিক-১, সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কৃত্রিমভাবে(Artificial) তৈরি উপগ্রহকে (Satellite)। তামাম বিশ্বের মানুষ এই ঘটনায় নড়ে চড়ে বসেছিলো। তারপর আরও উন্নত রকেট বানানোর পরিকল্পনা হতে লাগে। একটা সময় শুধু কল্পবিজ্ঞানের গপ্পে মানুষ পৃথিবী-গ্রহের বাইরে কোথাও সফর করতে পারতো। ষাটের দশকে মানুষ শুধু মহাকাশে নয়, পা ফেলেছে চাঁদের মাটিতেও। যে যানটার গবেষণা শুরু হয়েছিলো নেহাত যুদ্ধ জয়ের খাতিরে, আজ সেই রকেটের দৌলতেই কল্পনা পরিণত হয়েছে বাস্তবে।    

আমেরিকায় এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হোমার হিকাম আকাশে স্পুৎনিক-কে দেখতে পেয়ে স্বপ্ন দেখতো ভবিষ্যতে রকেট বানানোর। বন্ধুদের সাথে মিলে কত-না ঝড়-ঝাপটা সামলে শেষমেশ হোমার কাজটা হাসিল করেছিলো। বড় হয়ে তিনি হন বিখ্যাত মার্কিন মহাকাশ সংস্থা NASA-র প্রযুক্তিবিদ।  সেখানে তিনি মহাকাশচারিদের (Astronaut) তালিম দিতেন।  আমাদের এখানে হোমারের মত বহু কিশোর-কিশোরী আছে। তাদেরও ইচ্ছে ভবিষ্যতে রকেট-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার। এই লেখা পড়ে যদি তারা সামান্য হলেও উৎসাহ পায়, তবে সেটুকুই লেখকের পুরস্কার।  

…………………………………………………………………………………………………..

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

১। Wings of Fire An Autobiography by APJ Abdul Kalam with Arun Tiwary (Chapter 4: Achievers)

২। Cold War – Sputnik [E8/24] – YouTube

৩। 8.01x – Lect 17 – Impulse, Rockets – YouTube

৪। ‘বিজ্ঞানের মনোরঞ্জক খেলা’, আইয়র য়ুশিল (বেলুন হয় জেট বিমান)

৫। Mechanics & Thermodynamics of Propulsion by Hill & Peterson. (Chapter 10, Section 10.3: VEHICLE ACCELERATION)

৬। October Sky (1999) – IMDb

___________________________________________________________________



Categories: Science

Tags: , , ,

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: