- ডক্টর কুমারজিৎ মন্ডল
লেখক পরিচিতি : ডক্টর কুমারজিৎ মন্ডল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর । বর্তমানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক এর পিএইচডি। রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন ইকোনমিস্ট । IIT সহ দেশের বিভিন্ন প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বলেন।
এবছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপক তিনজন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অধ্যাপক ডেভিড কার্ড, ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক জশুয়া আ্যনগ্রিস্ট এবং স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গুইডো ইমবেন।নোবেল পুরস্কারের যে অর্থমূল্য তার অর্ধেক পাবেন অধ্যাপক কার্ড। বাকী অর্ধেক ভাগ করে নেবেন অধ্যাপক আ্যনগ্রিস্ট এবং অধ্যাপক ইমবেন। পুরস্কার কমিটির ঘোষণা অনুসারে অধ্যাপক কার্ড এই পুরস্কার পাচ্ছেন শ্রম সংক্রান্ত অর্থনীতির প্রায়োগিক শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য। অন্যদিকে অধ্যাপক আ্যনগ্রিস্ট এবং অধ্যাপক ইমবেন কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণের বিশেষ জটিল সমস্যার সমাধানে অভিনব সংখ্যাতাত্বিক পদ্ধতির সন্ধান দিয়েছেন।
অর্থনীতি এবং অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্রে একটা বড় চ্যালেজ্ঞ হল প্রথাগত ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্টের অভাব। পদার্থবিজ্ঞানী বা রসায়নবিজ্ঞানী ল্যাবরেটরিতে তার বিবেচনা মোতাবেক বিভিন্ন মানদণ্ড নির্দিষ্ট করতে পারেন এবং বারংবার এক্সপেরিমেন্টটির পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। এমন পুনরাবৃত্ত বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট থেকে পাঠ সংগ্রহ করে তিনি নির্ণয় করেন তার অভীষ্ট তত্ত্ব ঠিক না ভুল। এটা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় সম্ভব নয়।
অর্থনীতিতে ইকনমেট্রিক্স নামে একটি শাখা আছে। এখানে রাশিবিজ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে অর্থনীতির তত্ত্বগুলিকে যাচাই করার অবকাশ থাকে। এবছরের নোবেল প্রাপকদের অবদান এই ইকনমেট্রিক্সে এক নতুন পদ্ধতির সংযোজন। এই পদ্ধতি ওনারা প্রয়োগ করেছিলেন শ্রমের বাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্ব যাচাই করার জন্য।
ইকনমেট্রিক্স মূলতঃ বিভিন্ন চলরাশির মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করে। এর জন্য কার্যকারণ সম্পর্কিত অনেক সম্ভাবনাকে বাদ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয়।কিন্তু প্রায়শ এমন পরিস্থিতি আসে যে অন্য অযাচিত সম্ভাবনাগুলি বাদ দেওয়া যায় না।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের একটা উপায়ের সন্ধান আমরা পেয়েছি ফার্মাকোলজির গবেষকদের কাছ থেকে। রান্ডামাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) প্রয়োগের মাধ্যমে। এই ট্রায়ালগুলি কোন নতুন ওষুধের কার্যকারিতা পরিমাপের জন্য করা হয়। এই ট্রায়ালগুলিতে অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের কৃত্রিমভাবে দুই দলে ভাগ করা হয়। এক দলকে ওষুধটা প্রয়োগ করা হয় – এই দলকে বলে ট্রিটমেন্ট গ্রুপ। অপর দলকে দেওয়া হয় প্লেসিবো – এই দলকে বলা হয় কন্ট্রোল গ্রুপ।বর্তমানে করোনার প্রতিষেধক আবিস্কার সংক্রান্ত গবেষণার কল্যাণে এই পরীক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে আমরা কমবেশী ওয়াকিবহাল।মাইকেল ক্রেমার, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় এবং এস্তার ডাফলো এই পদ্ধতি সফলভাবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দুই বছর আগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
অর্থনীতি তথা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যা হল এখানে প্রায়শ আরসিটি প্রয়োগ করা যায় না। কারণ আরসিটির শর্ত মেনে গবেষকরা ট্রিটমেন্ট গ্রুপ আর কন্ট্রোল গ্রুপ তৈরী করতে পারেন না। যেমন কোন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের সুফল আরসিটির মাধ্যমে যাচাই করতে গেলে এলাকার কিছু বাড়ীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে এবং একই সঙ্গে কিছু বাড়ীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। এটা অনেক পরিস্থিতে রূপায়ণ করা অসম্ভব।
এখানেই ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্টের গুরুত্ব।এই এক্সপেরিমেন্টগুলিতে ট্রিটমেন্ট গ্রুপ এবং কন্ট্রোল গ্রুপ গঠন করা গবেষকের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। কোন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা কোন ঘটনার কারণে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীরা স্বাভাবিকভাবেই ওই দুই দলে ভাগ হয়ে পড়েন বা বলা যায় তারা নিজেরাই বেছে নেন নিজেদের গ্রুপ। তখন গবেষক এই স্বাভাবিক বিভাজনকে ব্যবহার করে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণের পথে অগ্রসর হতে পারেন। এবারের নোবেল ত্রয়ী এই পদ্ধতি ব্যবহার করে শ্রম বাজার সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন।
শ্রম বাজারে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল শিক্ষার সঙ্গে রোজগারের সম্পর্ক। সাধারণত দেখা যায় যারা তুলনামূলকভাবে বেশী দিন পড়াশোনা করেছে তাদের গড় রোজগার বেশী। আমেরিকায় ১৯৩০ সালে যারা জন্মেছে তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে যে এক বছরের অতিরিক্ত পড়াশোনার দরুন গড়ে তাদের সাত শতাংশ আয় বেড়েছে। কিন্তু এর ভিত্তিতে কি আমরা একটা কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণ করতে পারি – যেমন এক বছর বেশী পড়াশোনা করলে সাত শতাংশ আয় বাড়বে। এক কথায় উত্তরটা হল – পারিনা। কারণ যারা বেশীদিন পড়াশোনা করেছে তারা বেশী আয়ের কথা ভেবেই করেছে। তাছাড়া যারা বেশীদিন পড়াশোনা করেছে তাদের অনেকেরই মেধা এবং কুশলতা এমন স্তরের যে তারা ওই বাড়তি পড়াশোনা না করলেও তাদের আয় বেশীই হতো। এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিভাবে ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্ট ব্যবহার করা যায় সেটা আ্যনগ্রিস্ট এবং ক্রুয়েগার দেখালেন। আমেরিকায় সাধারাণত ১৬ বা ১৭ বছর বয়সে বাচ্ছাদের স্কুল শিক্ষা শেষ হয়।এই বাচ্ছারা একই বছরে জন্মগ্রহণ করে এবং তারা একই সঙ্গে একই শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে তাদের স্কুল শিক্ষা শুরু করে। সুতরাং যারা বছরের প্রথম দিকে জন্মগ্রহণ করেছে তারা অপেক্ষাকৃত বেশী সময় স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ পাবে যারা বছরের শেষ দিকে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের তুলনায়। আ্যনগ্রিস্ট এবং ক্রুয়েগার তুলনা করেছিলেন যারা বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আর যারা শেষ ত্রৈমাসিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে। তারা দেখেছিলেন যারা বছরের শেষ ত্রৈমাসিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের শিক্ষার সময়কাল প্রথম ত্রৈমাসিকে জাতদের থেকে কম এবং তাদের আয়ও কম। এই পরীক্ষণের মাধ্যমে তারা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে বেশীদিন ধরে শিক্ষাগ্রহণ এবং উপার্জনের মধ্যে একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। অতিরিক্ত একবছর শিক্ষাগ্রহণের ফলস্বরূপ আয়ের বৃদ্ধি হয় ৯ শতাংশ। এই ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্টকে কীভাবে নীতিনির্ধারণে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে পরবর্তীকালে আ্যনগ্রিস্ট এবং ইমবেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন।
শ্রম অর্থনীতিতে ন্যুনতম মজুরি এবং কর্মসংস্থানের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থনীতির পাঠ্যবইগুলোতে লেখা থাকে যে ন্যুনতম মজুরি বাড়লে কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। কিন্তু অধ্যাপক কার্ড এবং অধ্যাপক ক্রুয়েগার নিউ জার্সি (যেখানে ১৯৯০ সালে ন্যুনতম মজুরি বেড়েছিল) এবং পেনসিলভানিয়া (যেখানে ন্যুনতম মজুরি ওই সময় বাড়েনি) – এই দুটি শহরের ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের ওপর ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্ট করে দেখালেন যে পাঠ্যবইয়ের ধারণার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর অমিল।তাদের এই গবেষণার ফলে শ্রমের বাজারে ন্যুনতম মজুরির প্রভাব বিষয়ে আমরা অনেক বেশী তথ্য সমৃদ্ধ হয়েছি।
আরেকটা শ্রমসংক্রান্ত বিষয় যেটা মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশে জাতিগত দাঙ্গায় ইন্ধন যোগায় তাহলো অভিবাসন এবং শ্রমের বাজারে তার প্রভাব। একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে যদি কোন এলাকায় অভিবাসন বেশী হয় তাহলে সেই এলাকার শ্রমের বাজারে মজুরি কমে যায় এবং স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়। অধ্যাপক কার্ড এই ধারণাটিকে ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্টের সাহায্যে যাচাই করার চেষ্টা করেন। ১৯৮০ সালে কিউবা তার অধিবাসীদের স্বাধীনতা দেয় যে যারা দেশ ছেড়ে যেতে চায় তারা যেতে পারে। এরফলে মায়ামীতে অনেক অভিবাসী শ্রমিকের আগমন হয়। কিন্তু অধ্যাপক কার্ডের এক্সপেরিমেন্ট দেখায় যে এই অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যাবৃদ্ধি মায়ামীর শ্রমের বাজারে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি।
অধ্যাপক কার্ড, অধ্যাপক আ্যনগ্রিস্ট এবং অধ্যাপক ইমবেন বিগত ত্রিশ বছর ধরে ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্ট পদ্ধতিটিকে পরিমার্জন করেছেন এবং একে একটি তাত্ত্বিক পরিকাঠামো দিয়েছেন। অর্থনীতি তথা সমাজবিজ্ঞানে প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্রটি উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে এই ত্রয়ীর অবদানে।এবারের পুরস্কার তারই স্বীকৃতি।
Categories: Uncategorized
Leave a Reply