The author is a doctorate from Saha Institute of Nuclear Physics, Calcutta and a Professor, University of Calcutta.
এবারে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতে নিলেন তিন জন। এদের মধ্যে সিউকুরো মানাবে ও ক্লাউস হাসেলমান তাঁদের আবহাওয়ার পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার জন্যে পেলেন অর্ধেক এবং বাকি অর্ধেক পেলেন জিওরজিও পারিসি, যাঁর গবেষণার পরিধি কিঞ্চিত বিস্তৃত; প্রথম জীবনে মৌলিক কণা নিয়ে কাজ করলেও পরে প্রায় পুরোটাই statistical physics এর নানা বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে । নোবেল কমিটি এই তিনজনের কাজ এক সূত্রে বাঁধলেন কারণ ব্যাপক অর্থে তাঁদের তিনজনেরই কাজের বিষয় complex systems।
Complex বা জটিল system কাকে বলে এক কথায় উত্তর দেওয়া খুবই মুশকিল। তবে উদাহরণ হিসেবে আবহাওয়া যেমন আছে, তেমনিই আছে বেশ কিছু বস্তু যাদের নিয়ে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ফলাফলগুলি পদার্থবিদ্যার প্রচলিত ধ্যান ধারনার সাথে একেবারেই মিলছে না। কমপ্লেক্স সিস্টেমের আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় অর্থনীতিতে, বায়োলজিতে, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে ইত্যাদি। সাধারণ ভাবে বলা যায় এই জটিল সিস্টেম গুলো অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর উপাদানের সমষ্টি, যাদের মধ্যে নানারকম বল কার্যকরী হয়। এবং কমপ্লেক্স সিস্টেমে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আছে বিশৃঙ্খলা বা disorder এর। আর এই নিয়েই পারিসির মূল কাজ, বর্তমান লেখায় আমরা এ বিষয়েই কিছু আলোচনা করতে বসেছি।
আচ্ছা , পদার্থ কতরকম অবস্থায় থাকতে পারে? এর সোজাসাপ্টা উত্তর হল, তিন রকম, কঠিন, তরল বা গ্যাস। কঠিন বস্তুর মধ্যে অণু পরমাণু গুলো কোনো বিশেষ শৃঙ্খলা মেনে অবস্থান করে। তরল বা গ্যাসে তা হয় না, অপরদিকে তরল ও গ্যাস প্রবাহিত হতে পারে। তবে তরলের আয়তন অপরিবর্তিত থাকে, গ্যাসের থাকে না । একটা সময় অবধি এই তিনটি অবস্থার কথাই জানা ছিল। এবার কিছু কিছু বস্তু নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে – যেমন রাবার বা বালি । আপাতদৃষ্টিতে এগুলি মোটেও তরল নয়, কিন্তু পুরোপুরি কঠিনও তো নয়। এমনকি তরলের মত প্রবাহিতও হতে পারে। আরেকটি পদার্থ আছে যা নিয়েও প্রচুর চর্চা আছে, তা হল কাঁচ। কাঁচ কঠিন বস্তুর মত শৃঙ্খলা যুক্ত নয় আবার তরলের মতও ঠিক নয়। তাই এখন আর আমরা শুধু ওই তিনটে মাত্র অবস্থার কথা আর বলি না। এছাড়া বস্তু আবার আয়নিক অবস্থাতেও থাকতে পারে যাকে প্লাজমা স্টেট বলা হয়।
পারিসির সবচেয়ে বিখ্যাত গবেষণার কাজটা হল চুম্বক বা ম্যাগনেট জাতীয় পদার্থ নিয়ে। একটি বস্তুর মধ্যে চুম্বকত্ব বা magnetism থাকার জন্যে দায়ী মৌলিক কণার স্পিন নামক একটি বৈশিষ্ট্য, যেটা একমাত্র কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকেই বোধগম্য। এই স্পিনের একটি অভিমুখ থাকে। ম্যাগনেটের বিষয়টা সহজ করে এইভাবে বলতে পারি – ইলেকট্রনের স্পিনগুলোর মধ্যে একধরনের বল কাজ করে। তার ফলে স্পিন গুলোর অভিমুখ বেশির ভাগ এক দিকে থাকলে বস্তুটির মধ্যে চুম্বকত্ব পাওয়া যায়, একে বলা হয় ferromagnetic state – এটি একটু স্থূল ভাবে ভাবলে কঠিন বস্তুর সমকক্ষ বলা যেতে পারে, কারণ এখানেও সেই শৃঙ্খলা বা order দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আমরা বলি স্পিনগুলোর মধ্যে একটা ferromagnetic (সংক্ষেপে ferro) interaction বর্তমান। অপর দিকে স্পিনগুলির অভিমুখ একবারেই এলোমেলো হলে সেই অবস্থাকে বলা হয় paramagnetic, এটি একটি বিশৃঙ্খল বা disorderedঅবস্থা যখন স্পিনগুলোর দিক স্থির থাকে না – সময়ের সাথে তা ক্রমাগত পালটাতে পারে। আবার আরেক ধরনের বল কাজ করতে পারে স্পিনগুলোর মধ্যে যার ফলে তারা হয়ে ওঠে বিপরীতমুখী, এর মধ্যেও কিন্তু একটা শৃঙ্খলা বা order আছে, যাকে বলা হয় antiferromagnetic order এবং এক্ষেত্রে antiferromagmetic (সংক্ষেপে antiferro) interaction কার্যকরী। তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলে একসময় ferro/antiferro অবস্থা বা state আর স্থিতিশীল হয় না, অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে paramagnetic state এ পৌঁছে যায়। এটা খানিকটা কঠিন পদার্থের তরল অবস্থায় পরিবর্তিত হবার সাথে সমতুল্য। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগেই ম্যাগনেটের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে ও এইসব অবস্থার পরিবর্তন বা বিজ্ঞানের পরিভাষায় phase transition বোঝা গেছে বেশ কিছু বছর হল, প্রধানত statistical physics- এর দৌলতে ।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? ইতিহাসে বার বার এমন হয়েছে যে আমরা ভেবেছি আমরা বোধ হয় সব বুঝে গেছি আর ঠিক তখনই প্রকৃতি আমাদের সামনে কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। গত শতকের সত্তরের দশকে বেশ কিছু বস্তুর আচরণে দেখা গেল তাদের চুম্বক ধর্ম মোটেও প্রচলিত তত্ত্বগুলির সাথে মিলছে না। এইসব পর্যবেক্ষণ থেকে এরকম ধারনা হল যে আরও এক ধরনের স্থিতিশীল অবস্থা হতে পারে যখন স্পিন গুলোর অভিমুখ বিভিন্ন দিকে ঠিকই কিন্তু সময়ের সাথে তা পরিবর্তিত হচ্ছে না, যেন তারা হিমায়িত অবস্থায় আছে। এটা অনেকটা ওই কাঁচের মত তাই এই অবস্থার নাম দেওয়া হল স্পিন গ্লাস। অর্থাৎ এগুলোর মধ্যে কোন চুম্বকত্ব নেই, কারণ সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা আছে, কিন্তু আরেক ধরনের শৃঙ্খলা আছে যা প্যারাম্যাগনেটে থাকে না। Paramagnet এ সমবেত ভাবে স্পিনগুলো ধরলে শৃঙ্খলা তো নেই- ই, তদুপরি স্বতন্ত্র একটি স্পিনের অভিমুখও নিয়তই সময়ের সাথে পালটে যাচ্ছে, কিন্তু স্পিন গ্লাসে তা অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে, এটাই তফাৎ। এছাড়াও স্পিন গ্লাসের আরেকটা বিশেষত্ব আছে, সামগ্রিক ভাবে স্পিনগুলোর যে যে অবস্থান বা configuration এর জন্যে ferro বা para order থাকবে তা হাতে গোনা। অপরদিকে স্পিন গ্লাসে বলতে গেলে অসংখ্য অবস্থানের জন্যে নিম্নতম এনার্জি বা ground state পাওয়া সম্ভব।
কী কারণে কোনও বস্তু স্পিন গ্লাস অবস্থায় পৌঁছবে? স্পিন গ্লাসে অবশ্যই কোনো বিশৃঙ্খলা আছে, কারণ মোটের উপর ferro বা antiferro কোনও রকম কোনো order নেই, এমনকি কম তাপমাত্রাতেও। তাই এটি বোঝার জন্যে যে মডেল করা হল তাতে আবশ্যিক যে একটি স্পিন একাধিক স্পিনের সাথে যোগাযোগ রাখছে কিন্তু interaction গুলি paramagnetic ও ferromagnetic দুই ধরনেরই হতে পারে এবং এগুলি সুনির্দিষ্ট নয়, অর্থাৎ random. এই বিশৃঙ্খলতা এবং randomness এর মধ্যেই নিহিত আছে স্পিন গ্লাস বোঝার চাবিকাঠি। এই অনির্দিষ্ট ও মিশ্রিত ferro/antiferro বলের দরুন একটি স্পিনের অবস্থা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা মুশকিল কারণ বিভিন্ন স্পিন, যাদের সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখছে, তাকে বিভিন্ন অভিমুখে থাকার নির্দেশ দিচ্ছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে পদার্থবিদরা যাকে frustration বলে অভিহিত করেছেন এবং স্পিনগুলো তাই বিভিন্ন দিকে ন যযৌ ন তস্হৌ অবস্থায় বিরাজমান থাকে, একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে।
এতো গেল সম্যক একটা ধারনা, কিন্তু চাই গাণিতিক মডেলের সম্পূর্ণ সমাধান। Randomness এর জন্য প্রথাগত গাণিতিক পদ্ধতি দিয়ে স্পিন গ্লাসের উপযুক্ত মডেল গুলির সমাধান করা সম্ভব নয়। দরকার হল নতুন এক কৌশল, যার নাম replica method. এই নামকরণ করেছিলেন আরেক বিজ্ঞানী স্যার স্যাম এডওয়ার্ডস । Replica method এ খানিক সরলীকরণ করলে তাকে বলে replica symmetric method, এটি ব্যবহার করে দেখানো গেল সত্যিই স্বল্প তাপমাত্রায় স্পিন গ্লাস অবস্থা থাকা সম্ভব। কিন্তু পরে বোঝা গেল, সমাধান পাওয়া গেলেও, এটি অবাস্তব , কারণ তাপগতিতত্ত্বের মৌলিক কিছু শর্তের সঙ্গে এই সমাধান পরিপন্থী । পারিসি এইবার অভিনব ভাবে, যাকে বলা হয় replica symmetry breaking পদ্ধতি, সেটি আরোপ করলেন এবং সঠিক সমাধানে পৌঁছলেন গণিতের দুরূহ ও জটিল বেশ কিছু ধাপ পেরিয়ে।
এই কাজের এত গুরুত্ব কেন? এক তো হল এমনকি অত্যন্ত আধুনিক কম্পিউটার ব্যবহার করেও স্পিন গ্লাস মডেলের সমাধান মেলা কঠিন শুধু নয়, বলতে গেলে অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, পদার্থবিদ্যালব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে একেবারে অন্য ধরনের সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব। বাকি দুই নোবেল বিজেতা মানাবে ও হাসেলমান যেমন আবহাওয়ার পরিবর্তন পদার্থবিদ্যার সাহায্য নিয়েই চর্চা করেছেন। স্পিন গ্লাসের সঙ্গে গভীর সাদৃশ্য আছে এমন অনেক প্রক্রিয়া বা ঘটনা রয়েছে – কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মনে করা যাক একজন সেলসম্যানের কাজ নির্দিষ্ট কয়েকটি শহরে ঘুরে তার জিনিস বিক্রি করা। কোন পথে গেলে সে সবচেয়ে কম সময়ে প্রত্যেকটা শহর ঘুরে তার কাজ সারতে পারবে, এই সমস্যাকে একেবারে স্পিন গ্লাসের মডেলে ফেলে দেওয়া যায়। একই কথা প্রযোজ্য মস্তিষ্ক কিভাবে আংশিক তথ্য থেকে প্রায় নির্ভুলভাবে পুরো তথ্য উদ্ধার করতে পারে এই প্রক্রিয়ার জন্য – এটাও এক ধরনের বিশেষ স্পিন গ্লাস মডেল দিয়ে চর্চা করা হয়েছে। প্রোটিনও একটি কমপ্লেক্স সিস্টেম, তার সাথেও স্পিন গ্লাসের মিল আছে, প্রোটিন হল বহু অ্যামিনো অ্যাসিডের সমষ্টি ও বিশেষ বিশেষ আকারে সাম্যাবস্থায় থাকে – এই আকারের পোশাকি নাম protein folding. স্পিন গ্লাসের মতই প্রোটিনের এনার্জি নিম্নতম হয় অসংখ্য configuration এর জন্যে। এই মুহূর্তে স্পিন গ্লাস সংক্রান্ত আরো অনেক কূট প্রশ্নের উত্তর পেতে বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত। যে সব ক্ষেত্রে frustration বর্তমান (কোথায় আর নেই?!) এবং স্পিন গ্লাস ধরনের মডেল দিয়ে তাকে বিশ্লেষণ করা যায়, ওই তথাকথিত replica symmetric সমাধানই যথাযথ না replica symmetry breaking সমাধান প্রযোজ্য , এটি একটি অন্যতম অপরিহার্য প্রশ্ন।
অবশ্যই পারিসির কাজ কেবল মাত্র স্পিন গ্লাসে সীমাবদ্ধ নয়। অন্য বিভিন্ন জটিল সিস্টেমেও তাঁর অনেক অবদান। কিন্তু প্রধানত যে কাজটির জন্যে তাঁর সুনাম, আমরা সেদিকেই একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম এই পর্যন্ত।
Categories: Featured, Science, Uncategorized
Leave a Reply